‘বৈশ্বিক অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থায়ও চট্টগ্রাম বন্দর ৩ মিলিয়নের বেশি কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের মাধ্যমে রেকর্ড করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ১৭ মিলিয়ন কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে সক্ষম হবে বাংলাদেশ।’
বিশ্বব্যাংকসহ দেশি-বিদেশি অন্তত পাঁচটি প্রতিষ্ঠান আসছে, যারা ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এসব বিনিয়োগের আওতায় বে-টার্মিনাল নির্মাণসহ বন্দর কর্তৃপক্ষের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে ২০৩০ সালের মধ্যে ১৭ মিলিয়ন কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে সক্ষম হবে বাংলাদেশ। আর এর প্রত্যক্ষ প্রভাবে শক্তিশালী হবে দেশের অর্থনীতি।
বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম বন্দর ভবনের কনফারেন্স হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সার্বিক বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি এবং এর ধারাবাহিকতা, বিশেষ করে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের যে বিষয়টা…। প্রতি বছর ৮ থেকে ৯ শতাংশ যে বৃদ্ধি, সেটার জন্য সারাবিশ্ব এখন বাংলাদেশে বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
‘বে-টার্মিনালকে কেন্দ্র করে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করছি আমরা৷ অনেক দেশ, বিদেশি বড় বড় প্রতিষ্ঠান আমাদের অফার দিচ্ছে যে বে-টার্মিনাল হলে তারা বিনিয়োগ করতে চায়। ইতোমধ্যে পিএসএ সিঙ্গাপুর ও ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে আমাদের একটা বোঝাপড়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা ইতোমধ্যে পিপিপি প্রকল্প আকারে হাতে নিয়েছি, কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে চলছে।’
রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে যে মাল্টিপারপাস টার্মিনাল করার কথা, তাতে আবুধাবি পোর্ট গ্রুপ থেকে আমরা এক বিলিয়ন ডলারের একটা প্রস্তাব পেয়েছি। এখানে বিনিয়োগ করতে বিশ্বব্যাংকও যথেষ্ট আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
‘আশা করছি ২০২৪ সালের জুন-জুলাইয়ের মধ্যে বে-টার্মিনাল নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারব। পিএসএ সিঙ্গাপুর, ডিপি ওয়ার্ল্ড, আবুধাবি পোর্ট গ্রুপ, চট্টগ্রাম বন্দর এবং বিশ্বব্যাংক মিলে প্রায় সাড়ে ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার এখানে (চট্টগ্রাম বন্দরে) আগামী বছর বিনিয়োগ করবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে বে-টার্মিনালের মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদন দিয়েছেন। সেটির ডিজাইন, ডেসটিনেশন ও টেন্ডার ডকুমেন্টস আমরা প্রস্তুত করছি। পাশাপাশি আমাদের বন্ধু পিএসএ সিঙ্গাপুর, ডিপি ওয়ার্ল্ড এবং আবুধাবি পোর্ট গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য পিপিপির আওতায় কার্যক্রম এগিয়ে যাচ্ছে।’
বৈশ্বিক অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থায়ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে চট্টগ্রাম বন্দর রেকর্ড করতে যাচ্ছে বলে জানান বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর বর্ষপঞ্জি শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ আগেই ৩ মিলিয়ন কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ক্লাবে প্রবেশ করেছে। চলতি ২০২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর ৩০ লাখ ৪ হাজার ৫০৫ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করেছে। আশা করা যায় বছর শেষে চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় ৩ দশমিক ১ মিলিয়ন টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করতে সক্ষম হবে, যা গত বছরের প্রায় সমান।
‘তদুপরি চলতি বছরের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর ১১ কোটি ৮৩ লাখ ৪৫ হাজার ৫৭৬ টন কার্গো হ্যান্ডলিং করেছে, যা ৩১ ডিসেম্বর অর্থাৎ বছর শেষে ১২ কোটি টন ছাড়িয়ে যাবে। সে সুবাদে তা কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।
‘তাৎপর্যের বিষয় হলো, হ্যান্ডলিং করা এসব কার্গো- পুরোটাই দেশি পণ্য। তৃতীয় কোনো দেশের পণ্য আমরা হ্যান্ডলিং করিনি। এটা দেশীয় বাণিজ্যের স্থিতিশীলতা প্রমাণ করে। বৈশ্বিক অর্থনীতি খারাপ হলেও আমাদের বাণিজ্য ভালো রয়েছে৷’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের নবনির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) উদ্বোধন করেন। টার্মিনালটি পরিচালনায় সৌদি আরব ভিত্তিক বেসরকারি গ্লোবাল টার্মিনাল অপারেটর আরএসজিটিআইয়ের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষের। আগামী দু’মাসের মধ্যে এই টার্মিনালের কার্যক্রম শুরু হবে।’
কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বলেন, ‘সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম বন্দরের অধীনস্ত মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের চ্যানেল উদ্বোধন করেছেন। সেখানে প্রথম টার্মিনাল নির্মাণের জন্য তিনি ভিত্তি স্থাপন করেছেন। সেই টার্মিনালের টেন্ডার কার্যক্রম শেষ হয়েছে। আগামী দু’মাসের মধ্যে আমরা সেটার অনুমোদন পেয়ে যাব। আশা করা যায় ২০২৪ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিকে নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারব।’
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ‘ডেনমার্কের একটি প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস। তারাও একটা টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের প্রস্তাবটি পিপিপির আওতায় রাখা হয়েছে। আশা করছি আগামী বছরের জুন-জুলাই অথবা আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে এপিএম টার্মিনালস তাদের কার্যক্রম শুরু করবে।’
২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দর স্মার্ট বন্দর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে জানিয়ে রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, ‘ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোর বন্দর যেভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে, সেভাবেই ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দর স্মার্ট বন্দর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। তার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। সৌদিরা চলে এসেছে। আমরাও আমাদের কার্যক্রম শুরু করেছি।’
পিপিপির আওতায় বিনিয়োগের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে বিনিয়োগ করে তারা টার্মিনাল তৈরি করবে৷ তৈরির পর একটা নির্দিষ্ট সময় তারা তা পরিচালনা করবে। তারপর আমাদের কাছে হস্তান্তর করবে।’
তিনি বলেন, ‘মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর দেশের জিডিপিতে ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি যোগ করবে। বে টার্মিনাল তারচেয়েও বেশি বেশি যোগ করবে। সবকিছু মিলিয়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি যোগ করবে।
‘আমরা কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে এখন ৩ মিলিয়নের ক্লাবে আছি। ২০৩০ সালের মধ্যে ১৭ মিলিয়ন টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করবে।’
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ‘বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর একাই ৩ দশমিক ১ মিলিয়ন কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করছে। বে-টার্মিনাল হয়ে গেলে চট্টগ্রাম বন্দরে এককভাবে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ১১ থেকে ১২ মিলিয়ন টিইইউএস হবে।
‘পাশাপাশি পায়রা ও মংলা সমুদ্র বন্দর মিলে মোট ১৬ মিলিয়ন টিইইউএস কন্টেইনার ছাড়িয়ে যাবে। ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ১৭ মিলিয়ন টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা হবে বাংলাদেশের।’
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক, মাতারবাড়ী সমুদ্র বন্দরের প্রকল্প পরিচালক মো. জাহিদ হোসেন, বন্দরের ডেপুটি কনজারভেটর ক্যাপ্টেন ফরিদুল আলম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।