সাম্প্রতিক সময়ের বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনীর সড়ক ও মহাসড়ক। সড়কের ওপর দিয়ে প্রবল স্রোতে বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়ায় জেলার অন্তত সাড়ে ৪০০ কিলোমিটার সড়ক সম্পূর্ণ চলাচলে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এছাড়াও জেলায় অন্তত ৩ হাজার কিলোমিটার সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বন্যার পরবর্তী স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতিবেদনে জেলায় ৩ হাজার ৩৭৭ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে উঠে এসেছে। এছাড়াও ফেনীর ওপর দিয়ে অতিক্রম করা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক কোনো রকম মেরামত করে আপাতত যান চলাচলের উপযোগী করা হলেও এখন পর্যন্ত গ্রামীণ সড়কগুলো সংস্কার শুরু হয়নি। যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কে চলাচলকারীরা ব্যাপক বিড়ম্বনার মধ্যে রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে জেলার বিভিন্ন এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ইটের খোয়া বসিয়ে রাস্তাগুলো ব্যবহার উপযোগী করার চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক-মহাসড়ক মেরামতের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
জানা যায়, টানা বৃষ্টি ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বিগত ২১ আগস্ট থেকে তলিয়ে যায় ফেনী জেলার লোকালয়। এতে করে জেলার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। সড়ক-মহাসড়কের ওপর দিয়ে কোথায়ও কোথায়ও ৬ থেকে ৭ ফুট পানি প্রবাহিত হতে থাকে। বিদ্যুৎ, মোবাইল টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ফেনীতে মানবিক বিপর্যয় শুরু হয়। দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ এসে সহযোগিতা নিয়ে ফেনীবাসীর পাশে দাঁড়ায়।
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর জেলার বিভিন্ন বিভাগ ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন প্রস্তুত করে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রকাশিত জেলার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ ১৪টি খাতে ২ হাজার ৩৫২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে থাকা জেলার ১০টি বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জেলার শতাধিক হাট বাজার, শহরের শত শত আড়তদারের ক্ষয়ক্ষতির অংক ছাড়িয়ে গেছে হাজার কোটি টাকা।
জেলা প্রশাসন জানায়, বন্যায় ফেনীতে সড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট ও নদ-নদীর ক্ষতি হয়েছে ৭৪৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা। তন্মধ্যে ৪১২ কিলোমিটার সড়ক সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে ২৫৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার সড়ক আংশিক নষ্ট হয়ে ক্ষতি হয়েছে ৬৯৯ কোটি টাকা। এছাড়াও সম্পূর্ণ ক্ষতিগস্থ হয়েছে ১টি ব্রিজ, ২টি কালভার্ট ও ২টি নদী। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২টি ব্রিজ, ২২টি কালভার্ট, ২১টি নদী।
ফেনীর বন্যাদুর্গত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অনেক জায়গায় পাকা সড়ক ভেঙে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আবার কোথায়ও কোথায়ও বন্যার পানির প্রবল স্রোতে ভেসে গেছে সড়কের পিচ। বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হওয়ায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে ফেনীর বিভিন্ন উপজেলায় যাতায়াতের সড়কগুলো বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এখনও কোনো রকম ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলার অনেক গ্রামীণ সড়ক ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে গেছে। এসব এলাকায় মানুষ রাস্তা দিয়ে রিকশা নিয়েও চলাচল করতে পারছে না। বন্যার পর দুর্গত এলাকায় বিভিন্ন রোগব্যাধী ছড়িয়ে পড়লেও রাস্তা ঠিক না থাকায় তারা চিকিৎসার জন্য জেলা অথবা উপজেলা শহরে আসতে পারছে না। তাছাড়া গ্রামীণ সড়ক ঠিক না হওয়ায় বিভিন্ন হাট বাজারে এখনও চাহিদা মতো পণ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
পরশুরামের মির্জা নগর ইউনিয়নের রাঙ্গা মাটিয়া গ্রামের আলি আকবর জানান, ভারত থেকে নেমে আসা পানির চাপে তাদের বাড়ির পাশের রাস্তাটির কয়েক স্থানে বিলীন হয়ে গেছে। গাড়ি-ঘোড়াতো দূরের কথা। হেঁটেই এই সড়ক পার হওয়া যাচ্ছে না। যার কারণে মানুষ এ রাস্তা বাদ দিয়ে অন্য এলাকা হয়ে এ গ্রামের প্রবেশ করতে হচ্ছে।
চিথলিয়া ইউনিয়নের মাহমুদুল করিম জানান, আমাদের ইউনিয়নে আসার প্রধান সড়কে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তাটি এখন ব্যবহার করার কোনো পরিস্থিতি নেই। অনেক মানুষ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ঘরেই চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছে। এ রাস্তায় রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশাতেও আসতে চায় না।
মির্জা নগর ইউনিয়ন জামায়াতের আমীর মাওলানা নুর মোহাম্মদ বলেন, বন্যায় রাস্তাঘাট সব শেষ করে দিয়েছে। সরকারিভাবে মেরামত হওয়া শুরু হওয়া পর্যন্ত এলাকার মানুষ কিভাবে চলবে? আমরা ছাত্রশিবিরের লোকজনসহ স্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে সঙ্গে নিয়ে কয়েকটি রাস্তায় ইটের খোয়া দিয়ে কোনো রকম চলাচলের ব্যবস্থা করেছি।
ফেনীর স্থানীয় সরকার প্রকৌলশ অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ আল ফারুক বলেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ফেনীতে আমাদের আওতাধীন সড়কগুলোর পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি। এসব সড়ক মেরামত করতে দ্রুত বরাদ্দের জন্য বিভিন্নভাবে যোগাযোগ ও আলোচনা শুরু হয়েছে। নির্দেশনা পেলে প্রয়োজনীয়তা অনুসারে রাস্তাগুলো মেরামতের ব্যবস্থা করা হবে।
এদিকে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগস্টের বন্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও ফেনীর লালপোল এলাকায়। এ দুই এলাকায় বিভিন্ন স্থানে অন্তত ২০ কিলোমিটার সড়ক পানির নিচে ডুবে ছিল। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটির বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয় বড় বড় গর্ত। কোথাও কোথাও ডেবে যায়। ব্যাহত হয় যান চলাচলের স্বাভাবিক গতি, সৃষ্টি হয় যানজট। পরে জরুরি ভিত্তিতে মহাসড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ কোনো রকমে মেরামত করা হয়। তবে মহাসড়কটিতে ঠিক কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, সংস্কার করতে কত টাকা লাগতে পারে এসব বিষয় পর্যালোচনা করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেরামত কর্মসূচি গ্রহণের কথা জানিয়েছেন সওজের কর্মকর্তারা।
ফেনী সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী বিনয় কুমার পাল বলেন, বন্যার সময় অনেক যানবাহন মহাসড়কের ওপর আটকে পড়েছিল। এর মধ্যে পণ্যবাহী যানবাহনও ছিল। পানিতে তলিয়ে থাকা সড়কের ওপর দীর্ঘ সময় আটকে থাকার কারণে এসব যানবাহন সড়কের ক্ষতি করেছে বেশি। আবার পানিতে ডুবে থাকা সড়কের ওপর দিয়েও যানবাহন চলাচল করেছে। এটাও সড়কের ক্ষতি বাড়িয়েছে। অনেক জায়গায় সড়ক বিভাজকের মাঝখানে মাটি ভেসে গেছে। কিছু জায়গায় কালভার্টের নিচেও মাটি সরে গেছে। পেভমেন্টের কিছু সারফেসিং ক্ষতি হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা গর্তগুলো মেরামত করেছি। ভেঙে যাওয়া সড়ক বাঁধ জরুরি ভিত্তিতে মেরামত হয়েছে। কিছু জায়গায় ডাম্পিং করা হয়েছে, ফেলা হয়েছে বালির বস্তা। তবে এখনও কাজ চলমান।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক মেরামত করতে কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে এবং কবে নাগাদ এ কার্যক্রম শুরু হবে, জানতে চাইলে সওজের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান বলেন, মহাসড়কটির বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২০ কিলোমিটার অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সড়কের পাশাপাশি বিভিন্ন সেতুও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির তথ্যাদি এখনও চূড়ান্তভাবে পর্যালোচনা করা হয়নি। পর্যালোচনার পর বোঝা যাবে, কখন কী করতে হবে। যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা সবার আগে আমরা করব।